বালিকা সমৃদ্ধি যোজনা | Balika Samridhi Yojana in Bengali

বালিকা সমৃদ্ধি যোজনাটি (BSY) হল দেশের দরিদ্র কন্যাশিশুদের অবস্থার উন্নতি ও সুরক্ষার স্বার্থে করা ভারত সরকারের একটি উদ্যোগ। এই যোজনাটি নারী ও শিশু উন্নয়নের অধীনে ১৯৯৭ সালে প্রথম চালু করা হয়েছিল, যেখানে নারীদের ক্ষমতায়ন ও লিঙ্গ বৈষম্য দূর করতে অর্থনৈতিকভাবে সুবিধাবঞ্চিত পরিবারগুলিতে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়। বালিকা সমৃদ্ধি যোজনা (BSY) চালু হওয়ার পর থেকে এখনও পর্যন্ত ১.৫ লক্ষেরও বেশি মানুষ উপকৃত হয়েছেন।

বালিকা সমৃদ্ধি যোজনা কি?

ভারতে ২০১৯-২০২১ সালের হিসাব অনুযায়ী লিঙ্গ অনুপাতের হার হল প্রতি ১০০ জন মেয়ে হলে ছেলের সংখ্যা ১০৮ জন। লিঙ্গ বৈষম্যের দিকে বিশেষ নজর রেখে ভারত সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, যার মধ্যে বালিকা সমৃদ্ধি যোজনাটি সর্বাধিক সময় ধরে সাফল্যের সাথে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে চলেছে। 

দেশের অনেকাংশে, বিশেষত দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থিত পরিবারগুলিতে কন্যাশিশু জন্মের প্রতি অনীহা এবং শিশুকন্যা হত্যার প্রবনতা দেখতে পাওয়া যায়। শিশুর লিঙ্গ নির্ধারণ আমাদের দেশে বেআইনি ঘোষিত হলেও, জন্মের পরবর্তী পর্যায় শিশুকন্যা ত্যাগ বা হত্যার মতো ঘটনা গ্রামীণ ও শহরাঞ্চল উভয় ক্ষেত্রেই দেখা যায়।

বলাই বাহুল্য যে এই ধরণের ঘটনা অত্যন্ত নিন্দনীয় এবং যা একটি উন্নত সমাজে কখনই কাম্য নয়। তাই কেন্দ্রীয় সরকার ১৯৯৭ সালেই কন্যাদের ক্ষমতায়নের উদ্দেশ্যে বালিকা সমৃদ্ধি যোজনা (বিএসওয়াই) চালু করে যা কন্যাশিশুদের বেড়ে ওঠা এবং প্রাথমিক স্তর থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষালাভের সুযোগ ও বার্ষিক ₹১০০০/- টাকা পর্যন্ত আর্থিক সহায়তা প্রদান করে থাকে।

balika samridhi yojana bengali 1

সুকন্যা সমৃদ্ধি যোজনা

বালিকা সমৃদ্ধি যোজনা বিবরণ

বালিকা সমৃদ্ধি যোজনার বিবরণগুলি নিম্নবর্তী সারণীতে উল্লেখ করা হলঃ

প্রকল্পের নামবালিকা সমৃদ্ধি যোজনা
উদ্যোক্তাকেন্দ্রীয় সরকার
শুরুর সময়১৯৯৭ সাল
দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভাগনারী ও শিশু উন্নয়ন বিভাগ
লাভার্থীদারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থিত বালিকারা
উদ্দেশ্যশিশুকন্যাদের শিক্ষালাভের সুযোগ ও ক্ষমতায়ন করা
আর্থিক সহায়তার পরিমাণবার্ষিক ₹৩০০ – ১০০০/- টাকা
আবেদন পদ্ধতিঅফলাইন

বালিকা সমৃদ্ধি যোজনা উদ্দেশ্য

এই যোজনার উল্লেখযোগ্য উদ্দেশ্যগুলি নিচে তালিকাভুক্ত করা হলঃ

কন্যা সন্তানের জন্মকে উৎসাহিত করা

এই যোজনার অন্যতম উদ্দেশ্য হল অবশ্যই কন্যা শিশুদের প্রতি সমাজের মানসিকতায় পরিবর্তন আনা। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে যাতে কন্যা সন্তানের জন্মকেও সমান স্বীকৃতি ও সম্মান দেওয়া হয় সেদিকে নজর রাখা।

মেয়েদের শিক্ষার প্রচার করা

বালিকা সমৃদ্ধি যোজনার বার্ষিক বৃত্তি দারিদ্র্য সীমার নিচে অবস্থিত পরিবারের মেয়েদের শিক্ষালাভে উৎসাহিত করে। স্কুলে মেয়েদের ভর্তির সুযোগ এবং স্কুলে তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে ও মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষালাভে সহায়তা করে থাকে। তাই বলাই যায় যে সাক্ষরতার হার বৃদ্ধিতে এই প্রকল্পের প্রত্যক্ষ ভূমিকা রয়েছে।

বাল্যবিবাহ রোধ করা

এই যোজনা মেয়েদের শিক্ষা ক্ষেত্রে সুযোগ ও সহায়তা প্রদান করার ফলে মেয়েরা স্কুল শিক্ষা সম্পন্ন করতে পারে এবং একই সাথে এটি তাদের বৈধ বিবাহযোগ্য বয়সের আগে বিয়ে করা বা বাল্য বিবাহ রোধ করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করে।

লিঙ্গ বৈষম্য হ্রাস করা

এই প্রকল্প মেয়েদের ক্ষমতায়ন ও উচ্চশিক্ষা গ্রহণে সহায়তা করার মাধ্যমে কন্যা শিশুদের সুরক্ষা প্রদান করে, যা সমাজে লিঙ্গ বৈষম্য হ্রাস করতে সহায়তা করে।

আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নতি

এই প্রকল্পটি মেয়েদের দক্ষ ও উচ্চ শিক্ষিত করে তুলতে সহায়তা করে যার ফলস্বরূপ কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা বৃদ্ধি হয়, যা আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নতিতে প্রত্যক্ষ ভূমিকা গ্রহণ করে।

বালিকা সমৃদ্ধি যোজনা বৈশিষ্ট্য

বালিকা সমৃদ্ধি যোজনায় প্রাথমিকভাবে কন্যা সন্তানের জন্মের সময় কন্যার মাকে ₹৫০০/- টাকা দেওয়া হত। এছাড়া সেই কন্যা সন্তানের শিক্ষার জন্য বার্ষিক বৃত্তিও প্রদান করা হত। ১৯৯৯-২০০০ সালে যোজনাটির সুবিধা ও বৈশিষ্ট্যগুলি পুনর্গঠন করা হয়। 

বর্তমান সময়ের বালিকা সমৃদ্ধি যোজনার বৈশিষ্ট্যগুলি নীচে উল্লেখ করা হলঃ

  • নবজাতক কন্যা সন্তানের জন্মের পর তার মাকে ₹৫০০/- অনুদান প্রদান করা হয়।
  • ১৫ই আগস্ট, ১৯৯৭ তারিখের পরে জন্মগ্রহণকারী এবং বালিকা সমৃদ্ধি যোজনায় নিবন্ধিত মেয়েদের জন্য বার্ষিক বৃত্তি প্রদান করা হয়।
  • প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত প্রতিটি শ্রেণীর জন্য বার্ষিক বৃত্তির পরিমাণ হল ₹৩০০/- টাকা, চতুর্থ শ্রেণীর জন্য ₹৫০০/- টাকা এবং পঞ্চম শ্রেণীর জন্য ₹৬০০/- টাকা।
  • ষষ্ঠ থেকে সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত প্রতিটি শ্রেণীর জন্য বৃত্তির পরিমাণ ₹৭০০/- টাকা এবং অষ্টম শ্রেণীর জন্য ₹৮০০/- টাকা।
  • নবম থেকে দশম শ্রেণীর ক্ষেত্রে বৃত্তির পরিমাণ হল ₹১,০০০/- টাকা।
শ্রেণীবার্ষিক বৃত্তির পরিমাণ (প্রতি বছর)
প্রথম থেকে তৃতীয়₹৩০০/-
চতুর্থ₹৫০০/-
পঞ্চম₹৬০০/-
ষষ্ঠ থেকে সপ্তম₹৭০০/-
অষ্টম₹৮০০/-
নবম থেকে দশম₹১,০০০/-

বালিকা সমৃদ্ধি যোজনা যোগ্যতা

বালিকা সমৃদ্ধি যোজনার ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত যোগ্যতাগুলি প্রয়োজনঃ

  • গ্রামীণ এলাকার বাসিন্দাদের ক্ষেত্রে, স্বর্ণজয়ন্তী গ্রাম স্বরোজগার যোজনার অধীনে নির্দিষ্ট মানদণ্ড অনুসারে দারিদ্র্যসীমার নীচে থাকা পরিবারগুলিকে যোগ্য মানা হবে।
  • শহরাঞ্চলের ক্ষেত্রে, শহুরে বস্তিতে বসবাসকারী পরিবারগুলিকে এই যোজনার আওতায় রাখা হয়েছে, তার সাথে হকার, শাকসবজি ও ফল বিক্রেতা ইত্যাদি কাজ করা পরিবারগুলিও এই প্রকল্পের জন্য যোগ্য।
  • ভারত সরকারের নির্দেশে বিপিএল পরিবারগুলি নির্ধারণ করে গণবণ্টন ব্যবস্থা বা ‘পাবলিক ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম’ (টিপিডিএস) এর তালিকা প্রস্তুত করা হয়।
  • প্রতিটি পরিবার থেকে সর্বাধিক দুটি কন্যা সন্তানকে এই সমস্ত সুবিধা দেওয়া হবে।

বালিকা সমৃদ্ধি যোজনা ডকুমেন্টস

বালিকা সমৃদ্ধি যোজনায় আবেদনের জন্য নিম্নলিখিত নথিপত্রগুলির প্রয়োজনঃ

  • কন্যা সন্তানের বার্থ সার্টিফিকেট, যেটি সরকার কর্তৃক অথবা সন্তানের জন্ম হওয়া সেই হাসপাতাল কর্তৃক জারি করা হতে হবে।
  • বৈধ ঠিকানার প্রমাণপত্র যেমন ড্রাইভিং লাইসেন্স, পাসপোর্ট, টেলিফোন বা বিদ্যুৎ বিল, রেশন কার্ড, ভোটার আইডি কার্ড, অথবা ভারত সরকার প্রদত্ত অন্য কোনও প্রমাণপত্র।
  • পিতামাতা বা আইনগত অভিভাবকের পরিচয়পত্র যেমন পাসপোর্ট, প্যান কার্ড, ম্যাট্রিকুলেশন সার্টিফিকেট, আধার কার্ড, ভোটার আইডি কার্ড অথবা ভারত সরকার কর্তৃক প্রদত্ত অন্য কোনও সার্টিফিকেট যা থেকে কন্যা সন্তানের পরিচয় যাচাই করা যাবে।

বালিকা সমৃদ্ধি যোজনা ফর্ম

আপনাকে বালিকা সমৃদ্ধি যোজনায় আবেদনের জন্য ফর্ম পূরণ করতে হবে, তবে এক্ষেত্রে এখনও অনলাইনে ফর্ম পূরণের কোন রকম সুবিধা উপলব্ধ হয়নি। তবে আপনি অনলাইন থেকে ফর্ম ডাউনলোড করতে পারেন, সেক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে শহর ও গ্রামীণ অঞ্চলের সুবিধাভোগীদের জন্য আলাদা ফর্ম রয়েছে।

ফর্মটি ডাউনলোড করতে সরাসরি ক্লিক করুন বালিকা সমৃদ্ধি যোজনা ফর্ম

বালিকা সমৃদ্ধি যোজনার আবেদন

আপনি নিম্নলিখিত পদ্ধতিতে বালিকা সমৃদ্ধি যোজনার জন্য আবেদন করতে পারবেনঃ

  • আপনি গ্রামীণ অঞ্চলের অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী বা স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মীদের কাছ থেকে বালিকা সমৃদ্ধি যোজনার আবেদনপত্র সংগ্রহ করতে পারবেন। 
  • ফর্মটি প্রয়োজনীয় সকল তথ্য দিয়ে যথাযত ভাবে পূরণ করতে হবে।
  • আপনাকে এরপর আবেদনপত্রের সাথে সমস্ত প্রাসঙ্গিক নথিগুলি সংযুক্ত করতে হবে।
  • তারপর যেখান থেকে আপনি ফর্মটি পেয়েছেন, সেখানেই ফর্মটি জমা করতে পারবেন।

বালিকা সমৃদ্ধি যোজনার অন্যান্য শর্তাবলী

বালিকা সমৃদ্ধি যোজনা সংক্রান্ত অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি নিচে উল্লেখ করা হলঃ

  • এই যোজনার অধীনে সুবিধাভোগী কন্যা সন্তানের অর্থ একটি সুদযুক্ত অ্যাকাউন্টে জমা করা হয়।
  • এই অর্থের উপর সর্বোচ্চ সুদ প্রদান করা হয়ে থাকে, তাই সুবিধাভোগী এক্ষেত্রে পাবলিক প্রভিডেন্ট ফান্ড বা ন্যাশনাল সেভিংস সার্টিফিকেটের মতো সঞ্চয় প্রকল্পগুলি গ্রহণ করতে পারেন।
  • বালিকা সমৃদ্ধি যোজনার অধীনে শিশুকন্যার জন্মোত্তর অনুদান এবং বার্ষিক শিক্ষাগত বৃত্তির মধ্যে থেকে একটি অংশ ‘ভাগ্যশ্রী বালিকা কল্যাণ বীমা যোজনা’ -র অধীনে কন্যা সন্তানের নামে বীমা পলিসির প্রিমিয়াম পরিশোধের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। এছাড়া বৃত্তির অর্থ ইউনিফর্ম, পাঠ্যপুস্তক ইত্যাদি কেনার জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে এবং অবশিষ্ট অর্থ সুবিধাভোগীর অ্যাকাউন্টে জমা করা হবে।
  • কন্যা সন্তানের যখন ১৮ বছর বয়স হবে এবং সে অবিবাহিত থাকার জন্য পৌরসভা বা গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে সার্টিফিকেট পাবে, তখন সে ডাকঘর বা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তোলার অনুমোদন পাবে।
  • তবে যদি মেয়েটির ১৮ বছরের আগে বিয়ে হয়, তাহলে সে বার্ষিক বৃত্তির পরিমাণ এবং সুদ থেকে বঞ্চিত হবে। সে শুধুমাত্র জমা হওয়া সুদের সাথে ৫০০/- টাকা জন্মোত্তর অনুদান পাবে।
  • যদি ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগেই মেয়েটির দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যু হয়, সেক্ষেত্রে সম্পূর্ণ জমাকৃত অর্থ তুলে নেওয়া হবে।

Leave a Comment