ড্রাইভিং লাইসেন্স (DL) প্রকৃত পক্ষে অন্যান্য সরকারী নথির মতো হলেও, প্রথমবার এই কার্ড হাতে পাওয়ার স্বাদ একেবারেই আলাদা। অনেকেই আমরা ১৬ বছর বয়সের জন্য অপেক্ষা করে থাকি এই ড্রাইভিং লাইসেন্সটি হাতে পাওয়া যাবে বলে। এটি হল এক মুঠো স্বাধীনতা ও একই সাথে দায়িত্বের প্রতীক। এই নিবন্ধে কত ধরণের ড্রাইভিং লাইসেন্স হয়, আবেদন কিভাবে করবেন, স্ট্যাটাস চেক ও ডাউনলোড সম্মন্ধে বিস্তারিত তথ্য দেওয়া হল।
ড্রাইভিং লাইসেন্স কি
ড্রাইভিং লাইসেন্স হল রাজ্য সরকারের রিজিওনাল ট্রান্সপোর্ট অথরিটি দ্বারা জারি করা একটি ছাড়পত্র যা প্রধানত কোন মোটর চালিত যানবাহন যেমন বাইক, স্কুটার, প্রাইভেট কার, বাস, ট্রাক ইত্যাদি চালানোর জন্য দেওয়া হয়ে থাকে। মোটর ছাড়া যেসব যানবাহন আছে সেসব চালানোর ক্ষেত্রে লাইসেন্সের প্রয়োজন হয় না যেমন সাইকেল বা রিস্কা অথবা টানা ভ্যান গাড়ি ইত্যাদি। তবে ছোট মোটর চালিত গাড়ির ক্ষেত্রেও লাইসেন্সের প্রয়োজন হয় না যেমন ইলেকট্রিক সাইকেল বা রিক্সা প্রভৃতি।
এই ড্রাইভিং লাইসেন্স একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার জন্য ধার্য করা হয়ে থাকে যেমন ১৫-২০ বছর, তারপর পুনরায় এটি রিনিউ করাতে হয়।
যানবাহনগুলির ধরণের ওপর নির্ভর করে এই লাইসেন্সেরও বেশ কিছু ধরণ হয়ে থাকে, যেমন আপনার শুধু বাইকের লাইসেন্স থাকলে আপনি সেক্ষেত্রে গাড়ি চালাতে পারবেন না, তার জন্য আপনাকে গাড়ির লাইসেন্স করাতে হবে। আপনি একটি বা একাধিক যানবাহনের জন্য লাইসেন্স করাতে পারেন।
ড্রাইভিং লাইসেন্সের গুরুত্ব
যে কোন ধরণের যানবাহন চালানোর ক্ষেত্রে ড্রাইভিং লাইসেন্স বা তার আইনি শংসাপত্র থাকা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, কারন এই লাইসেন্স পাওয়ার জন্য ব্যাক্তিকে সেই নির্দিষ্ট ধরণের যানবাহন চালানোর দক্ষতার পরীক্ষা দিতে হয় এবং সাথে রাস্তার সিগনালের নিয়ম বোঝার দরকার পরে।
এই ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার প্রক্রিয়াটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যাতে কেউ ভাল ভাবে ড্রাইভিং শিখে, সাথে রাস্তার সিগনালগুলি বা হাতের ইশারাগুলি বুঝে তবেই এই লাইসেন্স পাওয়ার অধিকারী হতে পারেন। এই প্রক্রিয়া রাস্তাগুলিকে নিরাপদ রাখতে এবং সর্বোপরি মানুষের জীবন সুরক্ষিত রাখার উদ্দেশ্যেই গঠন করা হয়েছে।
ড্রাইভিং লাইসেন্সের ধরণ
ড্রাইভিং লাইসেন্স নিম্নলিখিত ৪ ধরণের হয়ে থাকে যথাক্রমে-
- MCWOG (মোটর সাইকেল উইদাউট গিয়ার) বা গিয়ারলেস টু-হুইলার যেমন গিয়ারলেস স্কুটি, মোপেড ইত্যাদি
- MCWG (মোটর সাইকেল উইথ গিয়ার) বা গিয়ারড টু-হুইলার যেমন মোটরসাইকেল/বাইক, গিয়ারড স্কুটার ইত্যাদি
- LMV (লাইট মোটর ভেহিকল) বা হালকা যানবাহন যেমন SUV, MUV, সেডান, হ্যাচব্যাক ইত্যাদি
- HMV (হেভি মোটর ভেহিকল) বাণিজ্যিক/ভারী যানবাহন যেমন বাস, ট্রাক, লড়ি ইত্যাদি
ড্রাইভিং লাইসেন্সের যোগ্যতা
পশ্চিমবঙ্গে ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য নিম্নলিখিত যোগ্যতাগুলি প্রয়োজনঃ
- গিয়ারলেস গাড়ির ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য ন্যুনতম বয়স হল ১৬ বছর।
- গিয়ারযুক্ত টু-হুইলার গাড়ির ড্রাইভিং লাইসেন্সের ন্যুনতম বয়স হল ১৮ বছর।
- ফোর-হুইলার বা লাইট মোটর ভেহিকল ড্রাইভিং লাইসেন্সের ক্ষেত্রেও ন্যুনতম বয়স হল ১৮ বছর।
- পরিবহন যানবাহন বা ট্রান্সপোর্ট ড্রাইভিং লাইসেন্সের ক্ষেত্রে ন্যুনতম বয়স হল ২০ বছর।
- ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য আবেদনের আগে আবেদনকারীকে লার্নার্স লাইসেন্স পেতে হবে।
লার্নার্স লাইসেন্স
আপনি যদি ড্রাইভিং লাইসেন্স করাতে চান তবে আগে আপনাকে লার্নার্স পারমিট পেতে হয়, কারন আপনাকে গাড়ি চালান শিখে তারপর পরীক্ষা দিয়ে তবে ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে হয়। আপনি যখন গাড়ি চালান শিখছেন সেই সময়ের অফিসিয়াল ডকুমেন্টেশন বা পারমিট হল এই লার্নার্স লাইসেন্স।
এই পারমিটটি ৬ মাস পর্যন্ত বৈধ থাকে এবং এটি রিনিউ করা যায় না। আপনি লার্নার্স পারমিট পাওয়ার ১ মাস পর থেকে ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য পরীক্ষা দিতে পারেন, অর্থাৎ আপনি মোট ৫ মাস পান পরীক্ষার জন্য। যদি পারমিটের ৬ মাস অতিক্রান্ত হওয়ার পরেও আপনার ড্রাইভিং লাইসেন্স না করান হয়ে থাকে তবে আপনাকে পুনরায় লার্নার্স লাইসেন্সের জন্য আবেদন করতে হবে।
ড্রাইভিং লাইসেন্সের প্রয়োজনীয় নথি
পশ্চিমবঙ্গে ড্রাইভিং লাইসেন্সের আবেদনের জন্য নিম্নলিখিত নথিগুলি প্রয়োজনঃ
- স্থায়ী ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য ফর্ম ২ আবেদনপত্র
- শারীরিক সুস্থতা প্রমান স্বরূপ ফর্ম ১ আবেদনপত্র
- ৪০ বছরের বেশি বয়সী আবেদনকারীদের জন্য ফর্ম 1A একজন চিকিৎসক দ্বারা স্বাক্ষরিত মেডিকেল সার্টিফিকেট
- প্যান কার্ডের ফটোকপি
- লার্নিং লাইসেন্সের ফটোকপি
- আধার কার্ড
- জন্ম শংসাপত্র বা অন্যান্য কোন বয়স প্রমাণপত্র
- পাসপোর্ট সাইজের ছবি
- পেমেন্ট রসিদ
ড্রাইভিং লাইসেন্স ফি পশ্চিমবঙ্গ
নিচের সারণীতে পশ্চিমবঙ্গের ড্রাইভিং লাইসেন্স ফি দেখান হলঃ
সার্ভিস ধরণ | ফি |
লার্নার লাইসেন্স ইস্যু করার ফর্ম ৩ | ₹১৫০/- |
লার্নার্স লাইসেন্স পরীক্ষার ফি বা রিপিট টেস্ট ফি | ₹৫০/- |
গাড়ি চালানোর দক্ষতার পরীক্ষা বা পুনরাবৃত্তি পরীক্ষার ক্ষেত্রে প্রতিটি শ্রেণীর যানবাহনের জন্য | ₹৩০০/- |
ড্রাইভিং লাইসেন্সের নথিকরণ | ₹২০০/- |
ড্রাইভিং লাইসেন্সে অন্য শ্রেণীর যানবাহন সংযোজন | ₹৫০০/- |
ড্রাইভিং লাইসেন্স রিনুয়াল | ₹২০০/- |
ডুপ্লিকেট লাইসেন্স ইস্যু | ₹৪০০/- |
ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার পদ্ধতি
নিম্নলিখিত পদ্ধতিতে আপনি RTO অফিস থেকে ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য আবেদন করতে পারবেনঃ
- আপনার লার্নার্স লাইসেন্সের কুল অফ পিরিয়ডের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরে আপনাকে রিজিওনাল ট্রান্সপোর্ট অফিস (RTO) যেতে হবে।
- আপনি যে ধরণের গাড়ির ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য আবেদন করতে চান, আপনাকে নির্দিষ্ট ট্র্যাকে সেই ধরণের গাড়ি চালানোর পরীক্ষা দিতে হবে।
- পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে তা তখনই আপনাকে জানিয়ে দেওয়া হবে এবং আপনার ড্রাইভিং লাইসেন্স কিছুদিনের মধ্যেই আপনার ঠিকানায় পৌঁছে যাবে।
- অন্যথা আপনি উত্তীর্ণ না হলে পুনরায় পরীক্ষার জন্য আবেদন করতে পারেন।
ড্রাইভিং লাইসেন্স অনলাইন আবেদন
আপনি নিম্নলিখিত পদ্ধতিতে অনলাইনের মাধ্যমেই লার্নার্স লাইসেন্স পাওয়ার জন্য আবেদন করতে পারবেনঃ
- আপনাকে পরিবহনের অফিসিয়াল পোর্টাল parivahan.gov.in/ তে যেতে হবে।
- হোম পেজের নিচের দিকে ‘License Related Services’ এর অধীনে প্রথম অপশন ‘Drivers/ Learners License’ এ ক্লিক করতে হবে।
- তাহলেই পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ট্রান্সপোর্ট ডিপার্টমেন্টের সারথি সার্ভিস পেজে পৌঁছাবেন যেখানে প্রথম অপশন ‘Apply for Learner Licence’ এ ক্লিক করতে হবে।
- এরপর ‘Continue’ তে ক্লিক করলেই ‘Application for Learner’s Licence (LL)’ পেজে পৌঁছে যাবেন যেখানে ‘Applicant does not hold any Driving/Learner licence issued in India’ তে ক্লিক করে ও ক্যাপচা পূরণ করে সাবমিট করতে হবে।
- আপনি আধার ভেরিফিকেশনের মাধ্যমে RTO অফিস না গিয়েও লার্নার্স লাইসেন্সের জন্য আবেদন করতে পারবেন তার জন্য আপনাকে ‘Submit via Aadhaar Authentication’ এ ক্লিক করতে হবে।
- এরপর পেজটির নিচে আধার নম্বর লিখে ও ওটিপির মাধ্যমে অথেনটিকেট করিয়ে নিতে পারবেন।
- অথেনটিকেশনের পর আবেদনের সম্পূর্ণ ফর্মটি আপনার সামনে খুলে যাবে, সেটি যথাযথ ভাবে পূরণ করে সাবমিট করতে হবে।
- এরপর আপনাকে ডকুমেন্ট রূপে ছবি ও সই আপলোড করতে হবে।
- তারপর অনলাইন পেমেন্টের মাধ্যমে লার্নার্স লাইসেন্সের ফি প্রদান করতে হবে, যেমন ২ হুইলারের জন্য ₹১৫০/- এবং টেস্টের জন্য ₹৫০/- অর্থাৎ মোট হল ₹২০০/- টাকা ইত্যাদি। আপনি অবশ্যই পেমেন্ট রিসিটটি প্রিন্ট বা ডাউনলোড করে রাখবেন।
- এরপর আপনি হোম পেজে গিয়ে ‘Application Status’ এ ক্লিক করে স্ট্যাটাসটি চেক করে নিতে পারবেন।
ড্রাইভিং লাইসেন্স স্ট্যাটাস চেক
নিম্নলিখিত ধাপগুলি অনুসরণ করে আপনি পোর্টাল থেকে ড্রাইভিং লাইসেন্সের স্ট্যাটাস চেক করতে পারবেনঃ
- আপনি ‘sarathi.parivahan.gov.in’ এ যান এবং স্টেট থেকে ‘West Bengal’ সিলেক্ট করুন।
- এরপর মেনুর ভেতর ‘Application Status’ এ ক্লিক করুন।
- এবার এপ্লিকেশন নাম্বার, জন্ম তারিখ এবং ক্যাপচা পূরণ করে সাবমিট করলেই স্ট্যাটাসটি দেখা যাবে।
ড্রাইভিং লাইসেন্স অফলাইন আবেদন
নিম্নলিখিত উপায় আপনি অফলাইনে ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য আবেদন করতে পারবেনঃ
- আপনি যখন প্রথমবার ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য আবেদন করবেন তার আগে অবশ্যই আপনার লার্নার্স লাইসেন্সটি (LL) থাকতে হবে। তার জন্য আপনাকে কাছের RTO (রিজিওনাল ট্রান্সপোর্ট অফিস) এ যেতে হবে এবং লার্নার্স লাইসেন্সের জন্য আবেদন করতে হবে।
- লার্নার্স লাইসেন্সের টেস্ট স্বরূপ আপনাকে ₹৫০/- ফি দিতে হয় এবং লার্নার্স লাইসেন্স ডকুমেন্টটির জন্য ₹১৫০/- টাকা ফি দিতে হবে।
- এলএল ইস্যু করার এক মাস পরে একটি ড্রাইভিং টেস্ট নেওয়া হয়ে থাকে, যার দিন ও সময় আপনি অফিস থেকেই জানতে পারবেন। এই টেস্টের জন্য আপনার ₹৩০০/- এবং লাইসেন্সের জন্য ₹২০০/- টাকা ফি লাগবে।
- আপনাকে নির্দিষ্ট দিনে পরিক্ষাস্থলে গিয়ে গাড়ি চালিয়ে টেস্ট দিতে হবে এবং আপনি টেস্টে পাস করেছেন কিনা তা তখনই পরীক্ষক/ইন্সপেক্টর আপনাকে জানিয়ে দেবেন।
- ড্রাইভিং টেস্টে উত্তীর্ণ হওয়ার কয়েকদিন পরেই আপনি পোস্টের মাধ্যমে আপনার ড্রাইভিং লাইসেন্সটি (DL) পেয়ে যাবেন।