কৃষক বন্ধু প্রকল্পটি হল রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ জনকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলির মধ্যে অন্যতম। কৃষকদের জন্য কল্যাণমূলক প্রকল্প কেন্দ্র সরকারের অধীনেও রয়েছে, তবে সেক্ষেত্রে আয় সীমার মতো একাধিক পূর্বশর্তের কারনে অনেক কৃষক কেন্দ্রের প্রকল্পের সুবিধা নিতে পারেন না। পশ্চিমবঙ্গের কৃষক বন্ধু প্রকল্পের কোনও পূর্বশর্ত না থাকার কারনেই প্রায় ১ কোটিরও বেশি কৃষক এবং ভাগচাষিরা এই প্রকল্পের সুবিধা গ্রহণ করেছেন।
পশ্চিমবঙ্গ সরকার যখন ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে এই প্রকল্পটি চালু করে, তখন প্রতি বছর কৃষকদের সর্বোচ্চ ₹৬,০০০/- টাকা করে অনুদান দেওয়া হত এবং পরবর্তীকালে ২০২১ সালে কৃষকবন্ধু (নতুন) প্রকল্প চালু হয়, যেখানে সহায়তার সর্বোচ্চ সীমা বাড়িয়ে বছরে ₹১০,০০০/- করা হয়। এই প্রকল্পের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত মোট ₹১৮,২৩৪ কোটি টাকা প্রদান করা হয়েছে।
আপনারা জানেন যে, এক্ষেত্রে যেসব কৃষকদের জমির পরিমাণ ১ একর বা তার বেশি, তাদের বছরে সর্বোচ্চ ₹১০,০০০/- টাকা, এবং যাদের জমির পরিমাণ ১ একরের কম তারা বছরে ₹৪,০০০/- টাকা করে আর্থিক সহায়তা পেয়ে থাকেন। এছাড়াও, এই প্রকল্পে ১৮ থেকে ৬০ বছর বয়সী কোনো কৃষকের অকাল মৃত্যুর ক্ষেত্রে, সেই পরিবারকে ২ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়ে থাকে।
এই প্রকল্পের দুটি কিস্তির অর্থ মরসুমের সময়ের ওপর নির্ভর করে দেওয়া হয়ে থাকে, যথা খরিফ ও রবি। সাধারনত প্রথম কিস্তির খরিফ মরসুমের অর্থ এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে এবং দ্বিতীয় কিস্তির রবি মরসুমের অর্থ অক্টোবর থেকে পরের বছরের মার্চ মাসের মধ্যে বিতরণ করা হয়ে থাকে।
চলতি বছরে বর্ষার আগেই কৃষকবন্ধু প্রকল্পের প্রথম কিস্তির টাকা ছাড়া হয়েছে। ১৩ই জুন থেকেই রাজ্যের প্রায় ১০.৫ কোটি কৃষকদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে খরিফ মরসুমের টাকা পাঠানোর কাজ শুরু হয়। সরকারি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে এখন পর্যন্ত রাজ্যের ৯৫% কৃষকরা তাদের টাকা পেয়েছেন, এবং বাকি ৫% কৃষকের মধ্যে নতুন কিছু কৃষক আছেন যাদের অ্যাকাউন্টে এখনো টাকা জমা হয়নি, তাদের জন্য আবারও টাকা পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে।
কৃষি বিভাগের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা বলেছেন যে যেহেতু বর্ষা আসার আগে কৃষকরা সহায়তা পেয়েছিলেন, তারা চাষের পরিকল্পনা তৈরি করতে পারেন যেমন তারা প্রথমে বীজতলা প্রস্তুত করতে পারেন এবং বর্ষা আসার সাথে সাথে চারাগুলিও প্রস্তুত করতে পারবেন।
চাষের কাজে ব্যবহৃত সার ও অন্যান্য কৃষি উপকরণের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় কৃষকরা তাদের চাষযোগ্য জমি কমাতে বাধ্য হচ্ছেন। তবে আশা করা যায় সময়মতো সহায়তা পৌঁছালে, কৃষকরা এ বছর কিছুটা হলেও বেশি জমি চাষ করতে পারবেন।
রাজ্য সরকার এই বছর ৭০ লক্ষ টন ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেছিল। তবে এখন পর্যন্ত মাত্র ৪৯ লক্ষ টন ধান সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে, এবং নতুন ফসল কাটার মৌসুম এক মাসের মধ্যে শুরু হওয়ায় এই সংখ্যা আর বাড়ার সম্ভাবনাও কম রয়েছে।
কৃষক বন্ধু প্রকল্পের অন্যতম উদ্দেশ্যই হল কৃষকদের কৃষিতে উৎসাহ এবং আর্থিক সহায়তা প্রদান করা। তবে এ ব্যাপারে একজন আধিকারিক বলেছেন যে, যতক্ষণ না একজন কৃষক তার উৎপাদিত পণ্যের সঠিক মূল্য পাচ্ছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে বৃহত্তর এলাকায় ফসল চাষে উৎসাহিত করা সম্ভব না। এছাড়া কিছু আধিকারিকগণ বলছেন যে, বর্ষার আগে অনুদান দেওয়া অবশ্যই প্রশংসনীয় উদ্যোগ, তবে সরকারের উচিত কৃষকদের ন্যায্য মূল্য পেতে সাহায্য করতে একটি কার্যকরী ক্রয় পরিকল্পনা তৈরি করা।
জানা গেছে যে, ভবিষ্যতে রাজ্যে আরও ক্রয় কেন্দ্র স্থাপন করা হতে পারে এবং কৃষকদের ফসল উৎপাদনে উৎসাহিত করার জন্য ধান সংগ্রহে কেন্দ্রের নির্ধারিত দামের পাশাপাশি অতিরিক্ত ইনসেন্টিভের ব্যবস্থাও করতে পারে।
কৃষক বন্ধু টাকা কবে ঢুকবে
কৃষক বন্ধু প্রকল্পে রবি মরসুমের টাকা সাধারণত ডিসেম্বর মাসে দেওয়া হয়ে থাকে, তবে এ বছর নভেম্বর মাসের মধ্যে কৃষকদের দ্বিতীয় কিস্তির টাকা দেওয়া হবে বলে ব্লক অফিস মারফত জানা গেছে।
এ বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে কৃষকদের জমির ফসল অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, বিশেষ করে আলু চাষীদের এ বছর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া সঠিক সময়ে জমিতে কীটনাশক ও সার প্রয়োগ না করতে পারার কারণে ফসলের উৎপাদনও বিশেষ হ্রাস পেয়েছে।
এই সমস্ত পরিস্থিতি বিবেচনা করে, কৃষক বন্ধু প্রকল্পের দ্বিতীয় কিস্তির টাকা নভেম্বর মাসে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে যে, অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ বা নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকেই রবি মরসুমের টাকা দেওয়ার কাজ শুরু হবে এবং সেক্ষেত্রে দুটি ধাপে অর্থ প্রদান করা হবে যথাক্রমে, প্রথম ধাপে পুরনো কৃষকদের এবং দ্বিতীয় ধাপে নতুন কৃষকদের।
এরূপ ধাপে ধাপে অর্থ প্রদানের প্রধান কারন হল যে নতুন কৃষকদের ক্ষেত্রে তথ্য আপলোড, অ্যাপ্রুভড, ভ্যালিডেশনের স্টেপগুলি সম্পন্ন করতে কিছু সময় লাগবে, তাই তাদের টাকা বিতরণে দেরি হবে।
অন্যদিকে, পুরনো কৃষকদের ক্ষেত্রে ভ্যালিডেশনের স্টেপগুলি জলদি হয়ে যাওয়ার কারনে তারা স্বাভাবিক ভাবে আগে টাকা পেয়ে যাবেন। জানা গেছে যে, নভেম্বর মাসের মধ্যেই সমস্ত কৃষকদের টাকা দেওয়ার কাজ সম্পন্ন হয়ে যাবে।
কৃষক বন্ধু স্ট্যাটাস চেক ২০২৪
কোন কৃষক এই প্রকল্পের টাকা পাবেন কিনা তা নিশ্চিত হতে স্ট্যাটাস চেক করাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারন এক্ষেত্রে যেসব কৃষকের স্ট্যাটাসে “Account Valid” দেখাচ্ছে, তাদেরই শুধুমাত্র টাকা দেওয়া হবে। তাই প্রত্যেক কৃষকদের উচিৎ তারা যেন অন্তত ছয় মাস অন্তর ব্যাংকে গিয়ে তাদের একাউন্ট নাম্বারের সাথে E-KYC করা আছে কিনা তা চেক করে নেন, কারন প্রত্যেক কিস্তিতেই এই সমস্যার জন্য অনেক কৃষকদের এই সহায়তা থেকে বঞ্চিত হতে দেখা যায়।
এই প্রকল্পে সহায়তার টাকা পাওয়ার ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি যে নতুন কৃষকদের ক্ষেত্রে টাকা কিছুটা দেরিতে এসেছে, যার প্রধান কারন হল যে, তাদের স্ট্যাটাসে প্রথমে “Ada Uploaded” এবং “Dda Approved” দেখানোর অনেক পরে “Account Valid” দেখানো হয়েছে, তাই তাদের টাকা অনেক দেরিতে পাঠানো হয়েছে। আবার কিছু কৃষকের ক্ষেত্রে ব্লক অফিস থেকে টাকা পাঠানোর পরেও সার্ভারের সমস্যা থাকার কারনে তাদের পেমেন্ট আটকে ছিল।
ব্লক অফিস থেকে জানানো হয়েছে যে, যেসব কৃষকের স্ট্যাটাসে “Payment Success” দেখানো হচ্ছে অথচ টাকা পাননি, তাদের ক্ষেত্রে ব্যাংক অ্যাকাউন্টের eKYC না থাকার কারণে টাকা জমা সম্ভব হয়নি। তবে এজন্য এই কৃষকদের দ্বিতীয়বার টাকা পাঠানো হবে না।
ব্লক অফিস থেকে আরও জানানো হয়েছে যে, আগস্ট মাসের ২০ তারিখের মধ্যে টাকা পাঠানোর প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হবে।
কৃষক বন্ধু স্ট্যাটাস চেকের ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত বিষয়গুলির ওপর নজর দিতে হবেঃ
- যদি কোন কৃষকের আধার কার্ডের নামের বানান বা জন্মতারিখ ভুল থাকে, তাহলে অবশ্যই দ্রুত আধার কেন্দ্রে গিয়ে তা সংশোধন করে নিতে হবে, নাহলে লিঙ্কিং ভুল থাকার কারনে আপনি টাকা নাও পেতে পারেন।
- কোন কৃষকের স্ট্যাটাসে যদি আধার নম্বর এবং kbid নম্বর না দেখায় তবে তাকে অবিলম্বে নিকটবর্তী ব্লক অফিসে গিয়ে আধার সংযুক্তিকরণের জন্য আবেদন করতে হবে। সংযুক্তিকরণের আবেদনপত্র জমা করার সময় অবশ্যই অরিজিনাল আধার কার্ড, ভোটার কার্ড এবং তার জেরক্স কপি নিয়ে যেতে হবে এবং জেরক্স কপিতে নিজের স্বাক্ষর করে তা জমা করতে হবে। আবেদনের ৭ থেকে ১০ দিন পর স্ট্যাটাস চেক করলে আপনার আধার নম্বর এবং kbid নম্বর দেখতে পাবেন।
- যে সমস্ত কৃষকদের আধার সংযুক্তিকরণের ফর্ম জমা করতে হবে, সেক্ষেত্রে তাদের কি সমস্যা রয়েছে তা ব্লক অফিস তাদের মোবাইল নম্বরে ম্যাসেজের মাধ্যমে জানিয়ে দেবে।
- যে সমস্ত কৃষকদের স্ট্যাটাসের ঘরে ‘Delete Farmer’ দেখাচ্ছে, তাদের অবিলম্বে ব্লক অফিসে গিয়ে নতুন করে জমির নথি ও ভোটার এবং আধার কার্ডের ফটোকপি দিয়ে পুনরায় ফর্ম জমা করতে হবে।
- যে সমস্ত কৃষকরা নতুন ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নাম্বার যুক্ত করতে চায়, তাদের পাসবুকের ফটোকপি ব্লক অফিসে জমা করতে হবে।
- যে সমস্ত কৃষকদের স্ট্যাটাসে ’No Data Found’ দেখাবে তাদের জমির নথিপত্র এবং ভোটার কার্ড ও আধার কার্ড নিয়ে ব্লক অফিসে যোগাযোগ করতে হবে।